এককালের সম্ভ্রান্ত পরিবারের আদরের একমাত্র কন্যা খুকি। আদর করে খুকি ডাকতে ডাকতে খুকিই তাঁর নাম হয়ে যায়। স্রষ্টা যেন মনের মতন রুপ ঢেলে বানিয়েছেন তাঁকে। যেমনি তাঁর রুপ তেমনি সচ্ছল এবং সম্মানিত পরিবারের মেয়ে ছিলো সে। বলতে গেলে লাখে একটি মেয়ে ছিলো খুকি। খুকির আগে আরো দুটি ভাই বোন হয়েছিলো কিন্তু দুজনেই জন্মের সাথে সাথেই মারা যায়। বহু প্রতিক্ষার পরে খুকির জন্ম হয়। ফলে আদর আহ্লাদের সীমা ছিলোনা তবুও লক্ষি মেয়ে ছিলো সে। সবার চোখের মণি ছিলো সে।
আদুরী খুকির লাল টুকটুকে একটি বেনারসির খুব শখ ছিলো। কন্তু তখনও বিয়ে কি জিনিস সেটি বোঝেনা খুকি তবুও মা বাবার কথায় খুশি খুশি রাজি হয়ে যায় বিয়ের পীড়িতে বসতে। বয়স তখন ১৪ তে সবে পড়েছে খুকির। বাবা মা বড় শখ করে ধুমধাম করে এক সুদর্শন রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দেন খুকির। ঠিক রাজপুত্রের মতনই দেখতে ছিলে এবং তাঁর সমকক্ষও কেউ ছিলেনা আশেপাশের দশ গ্রামে ! আচার ব্যবহার আর সৎ গুণে ভরপুর ছিলে ! বয়সটাও খুব একটা বেশী নয়। ১৮ বছর হবে। দুজনেই সোনায় সোহাগা।
তারপর রাঙা টুকটুকে সাজে পালকি চড়ে, খুকি বউ হয়ে এলো রাজপুত্রের গোছানো পরিপাটি মহলের রাণী হয়ে অথবা রাজপুত্রের বধূ হয়ে।
শুরু হয় দুজনের একটু একটু মেলামেশা, একটু একটু করে একে অপরকে বুঝতে শেখা। তাদের মিষ্টি মিষ্টি খুনসুটিতে চলে একটু একটু ভালোবাসার আদান প্রদান। তারপর নিজেকে পরিপূর্ণ নারীর দাবীতে একসময় রাজপুত্রের হাতে নিজেকে সপে দেয়া…।
এই নতুন নতুন সুখের সাথে আরেকটি খুশির বার্তা যেন বসন্ত হাওয়ায় দোলাতে থাকে তাদের সুখের ঘর ! ফুটফুটে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল খুকি। তারপর বেশ সুখে কেটে গেলো আরো ১০ টি বছর তাদের…..। এর মাঝে বাড়ি আরো আলোকিত করে জন্ম নিলো ৪টি ফুটফুটে সন্তান। কিন্ত কারও নজর লাগলো এ সুখে ! তাদের সাজানো সুখের বাড়ি ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে চিল শকুনের লোভাতুর দৃষ্টিতে !
একদিন ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক সেই রাতও এলো সুযোগসন্ধানী হায়েনার জন্যে সোনালী সুযোগ হয়ে !
রোজের ন্যায় সেদিনও রাজপুত্র ব্যাবসার পাঠ চুকিয়ে সন্ধ্যা রাতে বাড়ি ফিরছিলো নির্জন সরু পথ ধরে। হঠাৎ চারিদিক ঘিরে দাঁড়ালো সৎভাই (পিতা আগেই তাকে ত্যাজ্য পুত্র করে দিয়েছেন) ও তার সঙ্গী রাম দা হাতে ! ভয় দেখিয়ে বলল, অপরুপা সুন্দরী খুকি ও সমস্ত সম্পত্তি সবই আজ বুঝিয়ে দিবি !
কিন্তু জীবন চলে গেলেও কোনদিন তাঁর অমূল্য সম্পদ (খুকি) আর সম্পত্তি ওদের হাতে তুলে দেবেনা সেও সাফ জানিয়ে দিল!
তারপর…তারপর…
চরম আক্রোশে টুকরো টুকরো করে বস্তা বন্দি করে পাথর বেঁধে নদীর জলে ডুবিয়ে দিয়ে অবশেষে ক্ষান্ত ঐ নরপশু কুলাঙ্গার সৎভাই !
প্রায় দশটি দিন খুকি নাওয়া খাওয়া ভুলে রাত দিন তাঁর রাজপুত্রের অপেক্ষায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। এলোমেলো চুল, সন্তানদের প্রতিও নেই কোন খেয়াল শুধু অঝোরে কাঁদে আর পূর্বদিকের বাড়ি ফেরার পথটিতে অস্থির দৃষ্টিতে খোঁজে স্বামীর অবয়ব…! কিন্তু নাহ্ কোন খবর নেই তাঁর ! তবে কি সত্যিই… উহু খোদা এই শাস্তি তাকে দেবেন না ! নিজেকে বারবার স্বান্তনা দেয়….!
এদিকে আত্মীয় স্বজন , প্রতিবেশীরা তন্ন তন্ন করে খুঁজল কিন্তু নাহ পেলোনা ! কোথায় হারিয়ে গেলো লম্বা চওড়া সুন্দর মানুষটা?
অবশেষে ধরা পড়ল খুনি সৎভাই। গনপিটুনিতে একপর্যায় সেই হৃদয়বিদারক লোমহর্ষক বিদঘুটে রাতের বর্ণনা করল সে ! শিউরে ওঠা ঘটনার বর্ণনা শুনে পুরোগ্রাম কাঁদলো অঝর ধারায়…..। অবশেষে খুঁজে পেলো তারা সুন্দর তাজা যুবকের রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন কাপড়ের অবশিষ্টাংশ !
খুকি পাথর হয়ে গেলো। সুন্দর রাজপুত্রের ঐ রক্তাক্ত কাপড় বুকে আগলে তবুও অপলক তাঁকিয়ে থাকতো ফেরার ঐ সরু পথটির দিকে। তাঁর বিশ্বাস সে আসবেই তাঁর কিছু হয়নি। সবাইতো দিনের শেষে ঘরে ফিরে আসে সেও একদিন ফিরবে…।
সবাই কত বুঝিয়েছে খুকিকে ! কিন্তু দিনে দিনে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে সে। খুকির বাবা কতবার নিতে এসেছিলো তাকে কিন্তু যায়নি সে। বোবা হয়ে একাকী নির্জনে শুধু মিছেমিছে অপেক্ষা করত। একদিন সবার অগোচরে ফুটফুটে সন্তানদের তাদের দাদা দাদীর নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে শয্যাসায়ী টুকটুকিও চলে গেলো নির্মম দুনিয়া ছেড়ে। তাঁর রাজপুত্রের মায়াবী মায়ার লোভে তাঁরই খোঁজে…..।।।
আজো হয়ত খুকির অতৃপ্ত আত্মা তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামীর খোঁজে পূর্ব দিকের পথটিতে ঘুরে বেড়ায়…! নয়তো মৃত্যুর পরে তাঁরা নতুনভাবে সুখের সংসার পেতেছে ভিন্ন এক জগতে…।
এ গল্পটি কোন মনগড়া চিত্তবিনোদনের খোরাক নয় ! আজও এমন স্বজনহারাদের করুণ আর্তনাদ হরহামেশাই শোনা যায়।