আমাদের প্রথম কথা হয়েছিল জানুয়ারীর ৮ কিংবা ৯ তারিখে। সেদিনই সম্ভবত আমাদের ইউনিভার্সিটির প্রথম ক্লাস ছিল।
হঠাৎ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলি , এই তোমার নাম অন্তু?
আমি থতমত খেয়ে বলেছিলাম , হ্যাঁ। কিভাবে জানো ?
কিছু না বলে রহস্যময় হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলি ।
আমি মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিলাম সেইদিন । এতো সুন্দর ছেলেটা আমার সাথে কথা বলল । তাও নিজে থেকে , ভাবতেই ভালো লাগছিল । আবার আমার নামও কোন ভাবে জানে ।
তারপর প্রতিদিন তোকে দেখতাম । মুখভর্তি দাড়ি , লম্বাটে মুখ , অহংকারী চেহারার মধ্যে মুখভর্তি হাসি এমন চমৎকার লাগতে পারে তোকে দেখেই প্রথম টের পেলাম । নাক উঁচু করে ক্লাস্রুমে ঢুকতি । তারপর নাক গুজে এককোনায় বসে পড়তি ছবি আঁকতে । আমি আরচোখে তোকে দেখতাম । অসম্ভব ভাল লাগত দেখতে তোকে । মাঝে মাঝে ভাবতাম তোর সাথে যদি বন্ধুত্ব করা যেত । একদিন কথা বলে আর পরে কেন নিজে কথা বলতে আসিস না সেটাও ভাবতাম । নাকি নিজে গিয়েই কথা বলব । যদি বেহায়া ভাবে ? ভাবতে ভাবতে পুরো এক সেমিস্টার পার হয়ে গেল । আমার আর সাহস হল না তোর সাথে নিজে থেকে কথা বলার ।
পরের সেমিস্টার এ একদিন সুযোগ হয়েই গেল তোর সাথে কথা বলার । তোর এক বন্ধু জায়গা না পেয়ে আমার পাশে বসল । তুইও একটু পর এসে বসলি , এক কথায় দুই কথায় বন্ধুত্বের শুরু হল ।
তারপর থেকে আমাদের এক গ্রুপে চলাফেরা শুরু । আমার বাকী বন্ধুদের সাথেও তোর ভাব হয়ে গেল । আমি প্রথম থেকেই তোকে আর তিনাকে নিয়ে হাসাহাসি করতাম । তোরা দুইজনই খুব সুন্দর । মানাতো বেশ । যদিও আমার তোকে ভাল লাগত ।তখনও মুখ ফুটে বলার সাহস হয় নি । মজা করলেই তিনা রেগে মেগে অস্থির হত । তবে আমি কখনই বুঝতে পারি নি যে , তিনা তোকে ভালবেসে ফেলবে । আর আমি, আমি দেখতে সুন্দর না বলে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিলাম । অবস্থাটা আগের মত থাকলে হয়ত এখনকার মত বেসামাল হতাম না । তোকে দেখে অবশ্য কোনদিনই বোঝার কোন উপায় ছিল না তুই কাউকে পছন্দ করিস কিনা ।
তিনা তোকে পছন্দ করে এ কথাটা ও কাকে প্রথম বলেছিল জানিস ?
ঠিক ধরেছিস । আমাকেই ।
আমি কক্সবাজারে যাচ্ছিলাম বাসে করে হঠাৎ টুং করে ম্যাসেঞ্জারে শব্দ করে উঠল । তাকিয়ে দেখি তিনা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে ।
তিনা ঃ দোস্ত, আমি একজনকে পছন্দ করি । তুই তাকে অনেক কাছ থেকে চিনিস ।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল । খুব চাচ্ছিলাম তোর নাম যাতে না বলে । কিন্তু আমাকে ঠিক প্রমান করে দিয়ে তোর নামই বলল ।
আরো কি বলল জানিস ? বলল, আমি যাতে তোকে একটু বুঝিয়ে বলি । ও অনেক ভয় পাচ্ছে তোকে জানাতে । আমি বুঝতে পারছিলাম না কি বলব । বুকের ভেতর টা খালি হয়ে গিয়েছিল । নিজেকে অনেক অসহায় লেগেছিল । মনে হচ্ছিল আমার অনেক কিছু কেউ একবারে কেড়ে নিয়েছে ।
‘আচ্ছা’ । এতটুকুই লিখেছিলাম।
হাত কাঁপছিল , অনেক কষ্টে তোকে একটা ম্যাসেজ লিখলাম , ঘুমাচ্ছিস ? না ঘুমালে মিসকল দে , জরুরী কথা আছে । সেন্ড বাটন এ চাপার ৩০ সেকেন্ড এর মধ্যে তোর মিসকল ।
তোকে ফোন দিলাম।
বললাম , দোস্ত তিনা তোকে ভালবাসে । ও ভয় পাচ্ছে বলতে । আমাকে বলতে বলল ।
তুই প্রথমেই বিরক্ত হয়ে বললি , মানে ?
আমি আবার বললাম ,দোস্ত তিনা তোকে ভালবাসে । ও ভয় পাচ্ছে বলতে । আমাকে বলতে বলল ।
তুই খুব শান্ত কন্ঠে বললি , আচ্ছা , এ বিষয়ে পরে কথা বলব । আর কোন কথা আছে তোর ?
আমি বললাম , ‘না’ ।
তাহলে ফোন রাখ ,বলেই, নিজেই কেটে দিলি । আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । অনেকক্ষন ফোনটা হাতে নিয়ে বসেছিলাম ।
একমন বলছিল , এটার মানে নিশ্চই না । যাক , বাঁচা গেল । আরেক মন বলছিল না হলে তিনা খুব কষ্ট পাবে । আবার পরেই ভাবছিলাম , হয়ত ও সময় চাচ্ছে ভাবার । হয়ত কাল ও ‘ই’ তিনাকে ফোন করে ভালবাসার কথা বলবে । হাজার হাজার কথা মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছিল । কে জানে কি হবে ?
তখন রাত দু’টো বাজে । ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত কান্না করলাম । আলো হতে হতেই চোখ মুখে ফেললাম । রাতের কষ্ট রাতের গভীরেই হারিয়ে যাক । সকালে সুদীপদা ডেকে বলল , তোর কি জ্বর ? মুখ ফুলে আছে কেন ?
আমি বললাম , না ঠিক আছি , খুব মাথা ধরেছে । আসল কথাটা বলতে পারি নি , যে বুকের ভেতরটাই ধরে গেছে ।
সেই রাতের আগ পর্যন্ত ভাবতাম তোকে আমার ভাললাগে । শুধুই ভাললাগা । হঠাৎ করে অনুভব করলাম এক অদ্ভুতুড়ে অনুভুতি , হয়ত সেই অনুভুতিটার নাম ভালবাসা।
ভালবাসা শব্দটা খুব অদ্ভুত । অজানা ভয় , কখনো বা অনিশ্চয়তা , পাওয়ার ইচ্ছা , হারাবার ভয় , শব্দ , গন্ধ , ছোয়া সকল অনুভুতির সমষ্টি এ ভালবাসা । এক রাতে অনেকটা বড় হয়ে গেলাম । গল্পের পাতায় যে শব্দের পরিচয় , তার আজ হাতে কলমে শিক্ষা পেলাম । সেদিন থেকেই পাবার তীব্র ইচ্ছা জেগে উঠল। আর সেই সাথে হারাবার প্রবল ভয় ।
আজ এ পর্যন্তই থাক , ভালবাসার গল্পটার বাকীটুকু না হয় পরে হবে ।