মাঝারি দোচালা ঘর। ঘরের সামনে প্রশস্ত উঠোন। উঠোনকে কেন্দ্র করে আরো ছোট দুটি মাঝারি ঘর। একটি ঘরের সামনে থোকা গোলাপ, মোরগ ফুল ও মেহেদী গাছ। অন্য একটি ঘরের সামনে নেট দিয়ে আটকানো ছোট একটি ক্ষেতে বিভিন্ন শাক সবজির চারাগাছ। আরেক ঘরের সামনে একটি বরই গাছ। খোলা উঠোন জুড়ে রাজত্ব করছে বেশ কিছু হাঁস মুরগি । প্রতিটি ঘরের পেছনে রয়েছে নিজস্ব পুকুর। পুকুরের চারিপাশে ঝুলে পড়া ঝুমকো জবা এবং আরো বিভিন্ন জাতের বন্য ফুল। আর পুকুর জলে দু চারটা পদ্ম ফুল। কিন্তু পুকুরের ঐ পাশে জঙলি গাছের জঙ্গল । অপরুপ সুন্দর পরিবেশ। শান্তির নীড় যেন গ্রাম বাংলা।
বাড়িগুলোতে ঢোকার শুধু একটি সরু পথ আর পথের দু পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা পাতা বাহার গাছ ইত্যাদি । সেই সরু পথটি শুরু হয়েছে খালের পাশ দিয়ে । যে খালের এক মাথা সোজা নদীতে মিশেছে আরেক মাথা গ্রামের ভেতরে অবলিলায় বয়ে গেছে। খালে ছোট ছোট ঘাট বাঁধানো। ঘাটগুলোর কয়েকটাতে নৌকা বাঁধা। গাঢ় সবুজ গাছের ছাঁউনি ভেদ করে খালের ঘোলা জলে রোদের লুটুপুটি। ঝিরিঝিরি বাতাস এসে জলকে হালকা আলোড়িত করে ছোট ছোট ঢেউয়ের সৃষ্টি করে। ঢেউগুলো নৌকার গায়ে দোল খেলায় আর জলের ছলাৎ শব্দ যেন একরকম ছন্দ তোলে। গাছের ডালে ডালে সারাক্ষণ চলে পাখির আনন্দ উল্লাস । বিশেষ করে পড়ন্ত বিকেলে । কেউ নীড়ে ফিরেছে কেউ হয়তো বিদায় নিয়ে নীড়ে ফিরছে।
গ্রামের মানুষগুলো খুব সহজ সরল কিন্তু ছেলে মেয়েগুলো বেশ দুষ্ট। বড় বড় গাছের ডাল থেকে ঝাপিয়ে খালের জলে পড়ে আনন্দ করে। কেউ খালের ঘাটে কাপড় কাচে আবার মাঝি নৌকায় বসে গোসল করে।
প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ, কত আদিখ্যেতা । প্রতিবেশীর ঘরে যদি অতিথি আসে তবে সে আনন্দ যেন আশেপাশের দু চার বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়ে । অচেনা মেহমান হলেও নিজ থেকেই আপন সম্পর্ক গড়ে নেয় মানুষগুলো। ধনী বা গরীব যেই হোক তাদের রয়েছে একগাল হাসি আর বড় হৃদয়। আনন্দগুলো যেমন ভাগাভাগি করে নেয় কষ্টগুলোও ভাগাভাগি করে নেবার মত রয়েছে উন্নত মানসিকতা। এখানে প্রত্যেক পরতে পরতে যেন আপনের পরিচিতি আর নির্মল সুখের আবাস। কোন ঠুনকো আড়ম্বরতা নেই। ভালোলাগে বড্ড ভালোলাগে ঐ স্বচ্ছ গ্রামীণ পরিবেশকে। যেখানে ভেদাভেদ নেই সবাই যেন আপন আত্মীয়।
ফিরে আসি শহরে। এখানে তথাকথিত উন্নত সমাজ সভ্যতার চরম শিখরে। যার প্রথম বিকর্ষণ হল উঁচু উঁচু বহুতল ভবন, ধুলোবালি আর কর্কশ বিরক্তিকর গাড়ির আওয়াজ। জ্যাম হল এখানে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও কিছু কিছু এলাকায় কিছুটা স্বস্তির হাওয়া বয় তবে শহরের মানুষগুলোর হৃদয় যন্ত্র হয়ে গেছে। যেখানে হৃদয় নামক বস্তুটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জীবনের যুদ্ধ করতে করতে মানুষ বাঁচতেই ভুলে গেছে । আবার অনেকে অযথা প্রতিযোগীতা করতে করতে মনুষত্বই হারিয়ে ফেলেছে। সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। এতটুকু সহমর্মীতা সহযোগীতা নেই। ছুটে চলা জীবনে অনেক সময় পাশের মানুষটির দিকেও দৃষ্টিপাত করার সময় হয় না যেন। অথচ একটা বোবা পশুও স্বজাতির সাহায্যে এগিয়ে আসে, তবে মানুষ কি বিশ্বায়নের যুগে পশুর থেকেও অধম হয়ে যাচ্ছে!
গ্রামের মানুষ যেখানে অভাবীর অন্নটুকুও ভাগাভাগি করে নেবার মত সুন্দর মনুষত্ব রয়েছে, শহরে সেখানে ক্ষুধার জ্বালায় ডাস্টবিনের ময়লা খাবার খেতে দেখেও কারো হৃদয় এতটুকুও বিঘলিত হয়না। একেমন সভ্যতা? হ্যাঁ উন্নত আধুনিক সমাজ বটে। কথা বার্তার ধরণ, চালচলনে এবং পোশাকে বহির্বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে অনেকটা সক্ষমও তবে সভ্যতার শিক্ষা ঐ গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের থেকেই অর্জন করা সম্ভব।